খাঁচায় মাছ চাষের পটভূমি
বাংলাদেশে ‘খাঁচায় মাছ চাষ’ নূতন হলেও এশিয়ার কিছু দেশ যেমন চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং নেপালে এর প্রচলন বেশ প্রাচীন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ প্রতিযোগিতামূলকভাবে খাঁচায় মাছ চাষে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এদের অধিকাংশই খাঁচায় তেলাপিয়া চাষ করে মূলত: আন্তর্জাতিক রপ্তানী বাণিজ্যের জন্য।
এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানীকারক দেশ হলো তাইওয়ান। সে দেশে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজনের তেলাপিয়া খাঁচায় মজুদ করে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের তেলাপিয়া উৎপাদন করে, ফিলেট আকারে রপ্তানী করা হয়। দেশটি উচ্চ গুণগত মানের তেলাপিয়ার ফিলেট রপ্তানীতে শীর্ষে অবস্থান করছে। তাইওয়ান ২০০৬ সালে, ২০,০০০ মেট্রিক টন ফ্রোজেন তেলাপিয়া এবং ৩১০০ মেট্রিক টন তেলাপিয়ার ফিলেট রপ্তানী করেছে।
চীনে খাঁচায় মাছ চাষ বেশ জনপ্রিয়। ছোট খাঁচায় অধিক ঘনত্বে মাছ চাষের প্রচলন চীনেই প্রথম শুরু হয়। সম্পুরক খাবার প্রয়োগের মাধ্যমে খাঁচায় তেলাপিয়া ও কমন কার্পের চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়। ছোট ছোট খাঁচায় কমন কার্প অথবা তেলাপিয়া চাষ করা হচ্ছে। ২০০৬ সালে চীন শুধু আমেরিকাতে ৬৩ হাজার মেট্রিক টন তেলপিয়ার ফিলেট এবং ৪০ হাজার মেট্রিক টন ফ্রোজেন তেলাপিয়া রপ্তানী করেছে। সম্প্রতি জিম্বাবুয়েও ইউরোপের বাজারে তাজা ও ফ্রোজেন তেলাপিয়ার ফিলেট রপ্তানী শুরু করেছে।
থাইল্যান্ডের দণিাঞ্চলে খুব সাধারণ জাল দিয়ে তৈরি খাঁচায় কোরাল বা ভেটকী মাছের চাষ করা হয় এক বছর মেয়াদের জন্য। সমুদ্র থেকে আহরিত ছোট মাছ খাঁচাতে মাছের খাদ্য হিসেবে দেয়া হয়।
ভিয়েতনামে স্রোতশীল নদীতে খাঁচায় জলজ আগাছা সরবরাহ করে গ্রাস কার্প ও তেলাপিয়া চাষ করা হয়। এ ব্যবস্থাপনায় তেলাপিয়া মাছ গ্রাস কার্পের বর্জ্য মল খেয়ে থাকে। এক কেজি ওজনের মাছ উৎপাদন করতে ৩৫-৪০ কেজি সবুজ উদ্ভিদের প্রয়োজন হয়। এ পদ্ধতিতে ৩৫ ঘনমিটারের খাঁচা থেকে প্রতি বছর ১.৫- ২.৫ মেট্রিক টন পর্যন্ত মাছের উৎপাদন হচ্ছে। এ সকল খাঁচায় বড় সাইজের (৫-৬ ইঞ্চি) পোনা মজুদ করা হয়। প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে সবুজ উদ্ভিদের প্রয়োজন হয় বলে চাষিদের ব্যাপক শ্রম দিতে হয়।
খাঁচায় মাছ চাষে বাংলাদেশ
বাণিজ্যিকভাবে খাঁচায় মাছ উৎপাদনকে বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে সর্বপ্রথম জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচির অর্ন্তভূক্ত করা হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরীামূলকভাবে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ গ্রহন করে। সীমিত পরিসরের এ কার্যক্রম সময়ে সময়ে পরিচালিত হয় মূলত গবেষনা ও স্নাতকোত্তর ছাত্র – ছাত্রীদের পাঠক্রমের অংশ হিসাবে।
১৯৮০ সালে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে কাপ্তাই লেকে সর্বপ্রথম খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প হাতে নেয়। তবে দূর্বল ব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনীয় কারিগরী পদেেপর অভাবে প্রকল্পের কার্যক্রম আশানুরূপ ফলাফল লাভে ব্যর্থ হয়। এরপর ১৯৮৬-১৯৮৭ সালে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, কাপ্তাই লেকে ৭.০x৭.০x২.৫ ঘনমিটার আকারের খাঁচায় ইন্ডিয়ান মেজর কার্প চাষ করে ১০ মাস মেয়াদী ফসল আহরণ করে। হাতে বানানো খাদ্যের উপর নির্ভরশীল এ প্রচেষ্টাও সন্তোষজনক ফল প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কর্তৃক ১৯৮১-১৯৮৪ সালে খাঁচায় মাছ চাষের উপর বেশ কিছু পরীামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তন্মধ্যে ধানমন্ডি লেকে ৭.০x৪.০x২.৫ ঘনমিটার আকারের ভাসমান খাঁচায় নাইলোটিকার চাষ উল্লেখযোগ্য, তবে এেেত্র বাঁচার হার সন্তোষজনক হলেও সেখানে খাঁচায় নাইলোটিকার উৎপাদন সন্তোষজনক ছিল না। একই স্থানে ১৯৮৩-১৯৮৪ সালে খাঁচায় রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প ও নাইলোটিকা চাষ করা হয়। এেেত্র সব প্রজাতির মাছেরই মৃত্যু হার ছিল বেশি ও উৎপাদন ছিল নিতান্তই কম। উভয় ক্ষেত্রে লেকের পানি দূষণ, জালের প্রকৃতি ও মান সম্পন্ন খাদ্যের অভাবকেই বড় প্রতিবন্ধক মনে করা হয়।
১৯৮৭-১৯৯১ মেয়াদে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক কাপ্তাই লেকে খাঁচায় মাছ চাষের ওপর বিভিন্ন পরীা নিরীা করা হয়। এক বৎসর মেয়াদী চাষে হাতে তৈরি খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এেেত্র তেমন সন্তোষজনক ফল পাওয়া যায় নি।
১৯৯২ সালে কেয়ার বাংলাদেশ ও উত্তর পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ প্রকল্প একটি মহিলা দলকে নিয়ে রংপুরের কুকরুল বিলে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে বিলের ইজারাদার পরিবর্তনের কারণে এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ প্রকল্প সরাসরি কিছু মহিলা দলকে নিয়ে চিরিরবন্দরের কাঁকড়া নদীতে এবং পার্বতীপুরের বিভিন্ন স্থানে ১৯৯৩-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম সন্তোষজনকভাবে পরিচালনা করে। এখানে কাঁকড়া কর্তৃক জাল কেটে দেয়া একটা বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে উত্তর পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ প্রকল্প আরডিআরএস এর সাথে আদিতমারী ও ডিমলাতে পরীামূলকভাবে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করে। উত্তর পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ প্রকল্প এর অভিজ্ঞতায় খাঁচায় চাষের জন্য তেলাপিয়া সবচেয়ে ভালো প্রজাতি হিসাবে প্রতিয়মান হয়। এর পরই পাংগাসের অবস্থান।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে খাঁচায় মাছ চাষের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই কাংখিত ফল লাভ হয়নি। অথচ একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে দণি-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ খাঁচায় মাছ চাষে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। আমাদের দেশের খাঁচায় মাছ চাষ বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ও স্থায়ীত্বশীল না হওয়ার পিছনে কয়েকটি মৌলিক উপাদানের অভাবকেই কারণ হিসাবে চিহি্তৃ করা হয়। সেগুলো নিম্নরুপ:
মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশের আওতায় ২০০১ সালে মৎস্য প্রশিণ ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ জন কর্মকর্তাকে “মনোসেক্স তেলাপিয়ার বীজ উৎপাদন, পাঙ্গাসের কৃত্রিম প্রজনন ও খাঁচায় মাছ চাষ” এর ওপর প্রশিণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড প্রেরণ করা হয়। উক্ত প্রশিণার্থী দলের সদস্য হিসাবে প্রশিণ লাভ করেন মৎস্য প্রজনন ও প্রশিণ কেন্দ্র, রায়পুর, লক্ষ্মীপুরে তৎকালীণ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত জনাব মোঃ আসাদুল বাকী। প্রশিণ শেষে দেশে ফিরে জনাব আসাদুল বাকী প্রশিণলব্ধ প্রযুক্তি এবং স্বীয় অভিজ্ঞতার দ্বারা লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে মনোসেক্স তেলাপিয়া হ্যাচারী ও তেলাপিয়া উৎপাদন খামার “আম্বর ফিশারীজ” স্থাপনের কাজ শুরু করেন এবং ২০০২ সাল থেকে সফলতার সাথে মনোসেক্স তেলাপিয়ার বীজ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেন।
কুমিল্লা জেলার শিল্প নগরী এলাকায় (বিসিক) অবস্থিত জাল ও সুতা ফ্যাক্টরী “ফরিদ ফাইবার এন্ড উইভিং লিমিটেড” এর স্বত্বাধিকারী জনাব মো: বেল্লাল হোসেন জাল ফ্যাক্টরীর কাজে থাইল্যান্ড সফরকালে খাঁচায় মাছ চাষ দেখে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বাংলাদেশে খাঁচায় মাছ চাষের সম্ভাবনা দেখে নিজস্ব ফ্যাক্টরীতে খাঁচা তৈরির উপযোগী জাল উৎপাদন শুরু করেন। অতঃপর ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চাঁদপুর জেলার তৎকালীণ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, জনাব মো: ছেরাজ উদ্দিন, – এর সহযোগিতায় যথাযথ কর্তৃপরে অনুমতি নিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে প্রাথমিক ভাবে ৪০টি খাঁচা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ইতোমধ্যে মৎস্য প্রজনন ও প্রশিণ কেন্দ্র, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর এ কর্মরত জনাব মোঃ আসাদুল বাকী ২০০৩ সালের জুন মাসে বদলী হয়ে মৎস্য প্রশিণ ইনস্টিটিউট, চাঁদপুরে যোগদান করেন এবং থাইল্যান্ডের প্রশিণলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে কারিগরি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন এবং ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগের সাথে নিজকে সম্পৃক্ত করেন। সঠিক কারিগরী সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে ডাকাতিয়া নদীর চাঁদপুর সদর উপজেলার রঘুনাথপুর সরকারি প্রাইমারী স্কুল সংলগ্ন তীরে স্থাপিত স্থাপনায় খাঁচায় মাছ চাষ চলতে থাকে। দীর্ঘ তিন বৎসরের নিবিড় প্রচেষ্টা ও যথাযথ কারিগরী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর সফলতা আসে। সময়ের ব্যবধানে পোনার সহজলভ্যতায় ধীরে ধীরে খাঁচায় মাছ চাষে একক প্রজাতি হিসাবে মনোসেক্স তেলাপিয়ার উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি কেন্দ্রিভূত হয়। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মাছের ভাসমান খাবার সহজলভ্য হয়ে যায়। পরবর্তী দুই বৎসরে ক্রমান্বয়ে ডাকাতিয়া নদীতে আরো ছয়টি স্থানে খাঁচায় মাছ চাষের বিস্তৃতি ঘটে। মৎস্য প্রশিণ ইনস্টিটিউট, চাঁদপুর এ কর্মরত জনাব আসাদুল বাকী খাঁচায় মাছ চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণে প্রয়াসী হন। লীপুর জেলার অন্তর্গত সদর উপজেলার কয়েকজন উদ্যোক্তাকে নিয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে স্থাপিত মনোসেক্স তেলাপিয়ার হ্যাচারীর সন্নিকটে মেঘনা নদীর রহমতখালী চ্যানেলে তিনি ২০০৬ সালের জুন মাসে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেন এবং এবং এর যথাযথ সম্প্রসারণে উদ্যোগী হন এবং প্রয়োজনীয় প্রশিণ দিতে থাকেন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্যাক্তি উদ্যোগে উক্ত চ্যানেলে পাঁচ শতাধিক খাঁচা স্থাপিত হয় যাতে লাভজনকভাবে মনোসেক্স তেলাপিয়া উৎপাদন করা হচ্ছে। একই সাথে চাঁদপুরেও পরিচিত অনেককে উদ্ভুদ্ধ করেন ফলে তাঁর সরাসরি কারিগরি সহযোগিতায় মোমিনপুর মাদ্রাসা, গাছতলা ব্রীজ, দর্জিঘাট, গুনরাজদি এসকল এলাকায় ডাকাতিয়া নদীর অংশে স্থাপিত হয় শত শত খাঁচা।
মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষকে মাঠ পর্যায়ে আরো জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে জনগনকে উৎসাহিত করতে থাকেন। ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সংগতিপূর্ন বিবেচনা করে মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনাকে সহজলভ্য করার ল্েয চাঁদপুরেও একটি মনোসেক্স তেলাপিয়ার হ্যাচারী স্থাপনে প্রয়াসী হন। ২০০৬ সালে শুরু করেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় মনোসেক্স তেলাপিয়ার হ্যাচারী “পাইওনিয়ার হ্যাচারি এন্ড ফিশারিজ”। বর্তমানে এ হ্যাচারি থেকেও বৎসরে ন্যূনতম পাঁচ কোটি মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদিত হচ্ছে, যা অত্র এলাকার খাঁচায় মাছ চাষীদের চাষ কার্যক্রমের উপযোগিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সফলতার সাথে খাঁচায় মাছ চাষের এ অধ্যায় শুরু হয় চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীতে। এজন্য এখানকার ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন মডেলকে খাঁচায় মাছ চাষের “ডাকাতিয়া মডেল” নামে অভিহিত করা হয়।
অত:পর জনাব মো: আসাদুল বাকী মৎস্য অধিদপ্তরের আর্থিক বরাদ্দ লাভ করে বিভিন্ন গ্রুপে আশিরও অধিক খাঁচায় মাছ চাষীকে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। জনাব আসাদুল বাকী তথা মৎস্য প্রশিণ ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের তত্তাবধানে বর্তমানে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে এক হাজার আটশত খাঁচায় এবং লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর রহমতখালী চ্যানেলে সাড়ে পাঁচশত খাঁচায় মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ করা হচ্ছে, যা থেকে বৎসরে ন্যূণতম দেড় হাজার টন রপ্তানীযোগ্য তেলাপিয়া উৎপাদন করা হচ্ছে। সঠিক কারিগরী দিকনির্দেশনা ও তত্ত্বাবধায়নের ফলে এ খাঁচাগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম অগ্রসর হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে এবং পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থাপনায় এবং দিন দিন এটি সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর এ ব্যবস্থাপনার অনুকরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে খাঁচায় মাছ চাষ প্রযুক্তিটি ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে।
খাঁচায় মাছ চাষের উপযোগী স্থান নির্বাচন
খাঁচা স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন দুইটি বিষয় গুরুত্ব সহাকারে বিবেচনা করতে হবে। প্রথমতঃ জলাশয়ের প্রকৃতি, দ্বিতীয়ত: পরিবেশগত অবস্থান।
জলাশয়ের প্রকৃতি:
জলাশয়ের প্রকৃতির মধ্যে তিনটি প্রধান নিয়ামক (ভধপঃড়ৎ) কে বিবেচনায় নিয়ে জলাশয় নির্বাচন করতে হবে:
১। পানির গুনাগুন:
২। পানির গভীরতা:
৩। পানির স্রোত বা প্রবাহমাত্রা:
৪। পরিবেশগত বিবেচ্য:
খাঁচা তৈরীর উপকরণ ও ডিজাইন
চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে বাণিজ্যিকভাবে সাফল্যজনক খাঁচায় মাছ চাষের ইতিহাস বেশী দিনের নয়। ২০০২ সাল থেকে শুরু করে অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে যতটুকু বিস্তার ও স্থায়িত্ব লাভ করেছে তার প্রধান কারণ প্রয়োজনীয় উপকরণের সহজলভ্যতা ও প্রযুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন। এখানে নদীতে স্থাপিত খাঁচায় ব্যবহৃত উপকরণগুলোকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা:
১। খাঁচার জাল তৈরীর উপকরণ
২। খাঁচার ফ্রেম তৈরীর উপকরণ
৩। খাঁচা পরিচালনার জন্য উপকরণ
১। খাঁচার জাল তৈরীর উপকরণ
২। ফ্রেম তৈরী উপকরণ
৩। খাঁচা পরিচালনার জন্য উপকরণ:
খাঁচার ডিজাইন:
খাঁচার ডিজাইন নির্ভর করবে জলাশয়ের প্রকৃতি ও তার পারিপার্শি¦কতার উপর। নদীর ক্ষেত্রে, যেহেতু নদীর পাড় বরাবর খাঁচা স্থাপন করাটাই নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত, এবং নদীর অভ্যন্তরের দিকে ঝুঁকি বেশী এবং নৌ চলাচলে প্রতিবন্ধক হতে পারে, কাজেই খাঁচার আকার খুব বেশী বড় করার সুযোগ থাকে না। ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচাগুলো ২০ফুটx১০ফুট ফ্রেম তৈরী করে ড্রামের সাহায্যে ভাসমান রাখা হয় এবং একটি খাঁচার সাথে অন্যটি পার্শ¦ীয়ভাবে সংযুক্ত করা হয়। ফলে নদীর পাড় থেকে সুবিধাজনক গভীরতা যেখানে শুরু সেখান থেকে নদীর ভিতরের দিকে ২০ ফুট পর্যন্ত খাঁচা বিস্তৃত হয়।
হাওড়, বাওর ও বড় দীঘি লেক ইত্যাদি যেহেতু বিস্তৃত জলাশয় এবং এগুলোতে বড় নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কোন আশংকা থাকে না কাজেই এ সকল জলাশয়ে বড় আকারের খাঁচা স্থাপন করা সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশেই সমুদ্রে বিশাল পুকুরের অবয়বে খাঁচার মজবুত কাঠামো তৈরী করে খাঁচায় মাছ চাষ করা হয়। তেমনিভাবে আমাদের দেশের এ সকল জলাশয়ে অনেক বড় আকারের খাঁচা স্থাপন করা সমীচীণ। আবার যেহেতু এসকল জলাশয়ে অধিকাংশই মূল নদীর সাথে সংযোগ থাকে না আর কোন কোনটিতে থাকলেও তা শুধুমাত্র বর্ষাকালে ল্য করা যায় তাই এসকল জলাশয়ে পানির প্রবাহ বা স্রোত অনেকটা নেই বললেই চলে। কাজেই এ সকল ক্ষেত্রে খাঁচা স্থাপন করে মাছ চাষের ক্ষেত্রে মজুদ ঘনত্ব খুব বেশী বৃদ্ধি করা যাবে না। বরং মাঝারী ঘনত্বে মাছ মজুদ করে বেশী এলাকায় খাঁচা স্থাপনের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এতে একদিকে যেমন অক্সিজেন সমৃদ্ধ পানির দ্রুত পরিবর্তনের অভাবে মাছ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে অন্যদিকে খাঁচার তলদেশে মাছের বর্জ্য জমে বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মাছের মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে না।
খাঁচা তৈরী ও জলাশয়ে স্থাপন
জাল তৈরী:
বর্তমানে খাঁচা তৈরীতে যে জাল ব্যবহৃত হচ্ছে তা পলিইথিলিনের তৈরী ও গুনগত মান অনেক উন্নত। এগুলোর সবচেয়ে বড় উপযোগীতা হলে যে, কাঁকড়া, গুইসাপ, কচ্ছপ ইত্যাদি তিকর প্রাণী জালগুলো কাটতে পারে না। জালগুলো ফ্যাক্টরী থেকে সরবরাহ করা হয় থান কাপড়ের ন্যায়, যার উচ্চতা থাকে ২ মিটারেরও বেশী। ডাকাতিয়া মডেলের খাঁচার জন্য সাধারনত দুই আকারের জাল তৈরী করা হয়:
১। ৬ মিটারx৩ মিটারx১.৫মিটার
২। ৩মিটারx৩ মিটারx১.৫ মিটার
প্রথমত তলার জন্য দুই টুকরা জাল কেটে নিতে হবে। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২২ ফুট করে। কারণ সেলাই করার পর জাল সংকুচিত হয়ে দৈর্ঘ্য কমে যায় ও ২০ ফুটে এসে দাঁড়ায়। টুকরা দুটিকে লম্বায় পাশাপাশি রেখে গ্রীন হেংস ২৪ তারী সুতা দ্বারা পাশাপাশি মেঝের সাথে জোড়া দিতে হবে। এরপর তলার চারিদিকে ঘের দেয়ার জন্য ৬৮-৭০ ফুট জাল কেটে নিতে হবে। এবার ১১০ ফুট মরক্কো কাছি নিয়ে ৭০ ফুট জালের লম্বালম্বি কিনারার মেসের ভিতর দিয়ে পরাতে হবে। এরপর ঘের জালের একমাথা তলার এক কোনায় ধরে দেয়ালের মেসের সাথে তলার জালের মেসে গ্রীন হেংস দ্বারা সংযুক্ত করতে হবে। চার কোনায় দেয়াল নির্মানের জালের অংশ কিছু বেশী সংকুচিত করে সেলাই করতে হবে যাতে চার কোনায় জালের দেয়াল যথেষ্ট ঝুলে থাকে। এজন্য চার কোনায় ২ ফুট হিসাবে মোট ৮ ফুট জাল বেশী প্রয়োজন হবে।
অত:পর উপরের মরক্কো কাছিতে তলার চার কোনার বরাবর মেস গুনে চিহ্নিত করে উপরের কোনা নির্ধারণ করতে হবে। এক কোনা থেকে অন্য কোনা পর্যন্ত ২০ ফুট, ১০ ফুট ও ১০ ফুট মরক্কো কাছি চিহ্নিত করে ঐ ১০ফুট, ২০ ফুট মরক্কো কাছির মধ্যেই জাল আটকিয়ে গিট দিতে হবে। প্রতিটি গিটের সাথে ৩-৪ ফুটের লুপ তৈরী করতে হবে। এরপর মরক্কো কাছি ও গ্রীন হেংস থেকে জালের মেসগুলো যাতে সরে না যায় তার জন্য চিকন নাইলনের সুতা দ্বারা শক্তভাবে পেঁচিয়ে দিতে হবে।
জাল তৈরী হয়ে গেলে জালের চারকোণে চারটি বাঁশের খুটি স্থাপন করে তার সাথে জালটি বেঁধে নিতে হবে। এরপর প্রয়োজনীয় পরিমাণ (১০ ফুট কারণ এগুলো ২০ ফুট চওড়া হিসাবে উৎপাদন করা হয়)। ঢাকনা বা কভার জাল কেটে উপরের চারদিকে এমনভাবে সুতা দ্বারা বেঁধে দিতে হবে যাতে সহজে খোলা যায়।
ফ্রেম তৈরী:
ফ্রেমের অবয়ব নির্ভর করবে কোন পরিবেশে খাঁচা স্থাপন করা হবে তার উপর। পুকুরের পরিবেশে যেখানে পানির কোন স্রোত বা প্রবাহ নেই সেখানে পিভিসি পাইপ, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে ফ্রেম তৈরী করলেও চলবে। কিন্তু যেখানে স্রোত বা বিভিন্ন মাত্রার প্রবাহ বিদ্যমান সেখানে খাঁচার ফ্রেম অবশ্যই মজবুত ও শক্ত হওয়া প্রয়োজন।
ডাকাতিয়া নদীতে স্থাপিত খাঁচাগুলোর ফ্রেম তৈরী করতে প্রথমত: ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ দ্বারা ৬মিটারx৩মিটার ফ্রেম তৈরী করা হয় । একটি ফ্রেম তৈরীতে ২১ মিটার পাইপ ব্যবহৃত হয়। ৬মিটার আকারের পাইপ নিয়ে মাথার দিকের প্যাঁচ কাটানো অংশ কেটে ফেলে দেয়া হয়। অত:পর ১ফুট ফ্যাটবার বাঁকা করে বাহির দিক দিয়ে কোনাগুলোকে ঘিরে ঝালাই করা হয়।
আর
মাঝে ৩মিটার আরেকটি পাইপ বসিয়ে ঝালাই করে ফ্রেম তৈরী করা হয়। এতে সরাসরি ৩মিটারÍ৬মিটারx৩মিটার আকারের খাঁচা বসানো যায় আবার প্রয়োজনবোধে ৩মিটার খাঁচাও বসানো যায়। এভাবে ফ্রেমগুলো তৈরী করে একটির সাথে অন্যটি সংযুক্ত করে খাঁচার আকারে সাজিয়ে ইউনিট তৈরী করা হয়।
একটি ফ্রেমের সাথে অন্যটি সাজানোর জন্য এবং সেগুলো পানিতে ভাসমান রাখার জন্য দুইটি ফ্রেমের মাঝে ৩টি ড্রাম বসানো হয়। দুই ফ্রেমের মাঝে ড্রাম দিয়ে ফ্রেম দুটোকে ১৭-১৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের রড দিয়ে (দুই মাথায় কাম্প তৈরী করে) সংযুক্ত করা হয়। আবার ড্রামের উপরে বসানোর মতো ৩ সুতা রডের ফ্রেম তৈরী করেও রডের ফ্রেমের সাথে জিআই পাইপের মূল খাঁচার ফ্রেম বেধে দেয়া যাবে।
খাঁচা স্থাপন:
খাঁচা স্থাপনের যাবতীয় উপকরণ সংগ্রহ করে নদীর পাড়ে যেখানে খাঁচা স্থাপন করা হবে সেস্থানে নিতে হবে। জিআই পাইপের ফ্রেমগুলো আগেই নিকটবর্তী কোন ওয়ার্কশপ থেকে ঝালাই করে ফ্রেম তৈরী করে খাঁচা স্থাপনের এলাকায় আনতে হবে।
একসাথে জায়গার উপযোগীতা মোতাবেক ১০-১২ টি ফ্রেম পাশাপাশি রেখে প্রতি দুটো খাঁচার মাঝে তিনটি করে ড্রাম বসিয়ে সংযোগকারী লোহার ফ্রেম দ্বারা আটকাতে হবে। ড্রামগুলো যাতে নীচ দিয়ে সরে না যায় সেজন্য দুই ফ্রেমের পাইপের সাথে ভালোভাবে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। এরপর সম্পূর্ণ ফ্রেমের দৃঢ়তার জন্য চারদিকে জিআই পাইপের সাথে এবং মাঝের জিআই পাইপের সাথে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সোজা বাঁশ বেঁধে দিতে হবে। এরপর প্রয়োজনীয় জলবলের সহযোগিতা নিয়ে একসাথে সতর্কতার সাথে সম্পূর্ণ খাঁচার ফ্রেমকে পানিতে ভাসাতে হবে। এভাবে সমস্ত খাঁচা পানির উপরে তথা ডাঙ্গাতে বেঁধে পরে পানিতে ভাসাতে হবে।
প্রত্যাশিত গভীরতায় খাঁচা ভাসানো হলে এর দুদিকে দুইটি এবং খাঁচা ইউনিটের দৈর্ঘ্য বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক গেরাপী বা নোঙর মোটা গ্রীন হেংস কাছি (১২ নং) দিয়ে বেঁধে উপযোগী দুরত্বে নদীতে সেট করতে হবে।
এরপর ধীরে ধীরে খাঁচার জাল ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে, খাঁচাগুলো ফ্রেমে সাথে বাঁধতে হবে। খাঁচায় মাছ মজুদের কমপে ১৫ দিন পূর্বে জালগুলো সেট করে ফেলতে হবে। এতে জালের গায়ে সামান্য শ্যাওলা পড়বে। ফলে মাছ মজুদের পর নূতন জালের ঘর্ষনজনিত আঘাত থেকে মাছ রা পাবে।
খাঁচায় চাষ উপযোগী মৎস্য প্রজাতি
খাঁচায় মাছ চাষ স্বাভাবিক জলাশয়ে বা পুকুরে মাছ চাষের চেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ। এখানে পুকুরের চেয়ে অনেক বেশী ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। খাঁচার মাছ শুধুমাত্র বাহির থেকে সরবরাহকৃত সম্পূরক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল, তাই পুকুরের ন্যায় বিস্তৃত পরিবেশে প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্য বিচরণ করতে পারে না। আর আবদ্ধ পরিবেশে থাকার কারণে আক্রমণাত্বক স্বভাবের কোন মাছ থাকলে তার আক্রমণ থেকে রার জন্য দূর্বল মাছ কোন নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে না। আবার ব্যবস্থাপনার অংশ হিসাবে প্রতিনিয়ত মাছগুলো নাড়াচাড়া করে স্থানান্তর করতে হয়। এ ধরণের ব্যবস্থাপনার পীড়ন সহ্য মতা না থাকলে মাছ মারা যেতে পারে। পানির স্বাভাবিক পরিবর্তণ কোন কারণে ব্যাহত হলে কিংবা তলার বর্জ্য পদার্থের প্রত্যাশিত অপসারণ না হলে খাঁচার পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে যেতে পারে। ইত্যকার বিষয়গুলো বিবেচনা করেই বিভিন্ন দেশে নিজ নিজ ভৌগলিকভাবে সহজলভ্য প্রজাতির মাছই খাঁচার জন্য নির্বাচন করা হয়। সাধারণভাবে খাঁচার চাষের জন্য মৎস্য প্রজাতিগুলোর নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্য গুলো বিবেচনা করা হয়:
বর্ণিত বৈশিষ্টাবলী বিবেচনায় এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে খাঁচায় চাষের প্রজাতি হিসাবে নিম্নলিখিত মাছগুলোকে নির্বাচন করা হয়:
পূর্বে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে খাঁচায় মাছ চাষের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়েছে। শুরুর দিকে অনেকে খাঁচায় পাঙ্গাস মজুদ করতেন। কিন্তু ক্রমহ্রাসমান বাজার মূল্যের কারণে আজকাল খাঁচায় পাঙ্গাস চাষ লাভজনক বলে মনে হয় না। বর্তমানে অধিকাংশ খাঁচাতেই একক প্রজাতি হিসাবে মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ করা হচ্ছে। এর কারণ হলো নার্সিং করে খাঁচায় মজুদ করা হলে মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানেই খাঁচা থেকে মাছ আহরণ ও বিক্রয় করা যায়; আর ক্রমবর্ধমাণ চাহিদা অনুসারে দেশেই মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে বিভিন্ন হ্যাচারীতে। এর সাথে সাথে আরো কিছু প্রজাতির মাছের পোনা খাঁচায় মজুদ করে উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যেই লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরের বিভিন্ন খাঁচায় সীমিত মাত্রায় থাই স্বরপুটি, থাই কৈ, কমন কার্প, চিংড়ি ইত্যাদি মজুদ করা হয়েছে পরীামূলকভাবে। আমাদের দেশী কৈ, শোল, শিং মাগুর মাছও খাঁচায় চাষ করা সম্ভব; তবে এ সকল মাছের পোনা প্রাপ্তিই প্রধান প্রতিবন্ধক বলে মনে হয়। পোনা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে ও উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার সহজলভ্য হলে ব্যাপকভাবে খাঁচায় এসকল প্রজাতির মাছ চাষ সম্ভব হবে।
খাঁচায় চাষ উপযোগী আমাদের দেশের মৎস্য প্রজাতি:
খাঁচায় মজুদ উপযোগী মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা
খাঁচায় মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ
খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে পোনার মজুদ ঘনত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বল্প আয়তনে প্রত্যাশিত উৎপাদন পেতে হলে মজুদ ঘনত্ব যত বাড়ানো যায় ততই ভাল। তবে এই ঘনত্ব বাড়ানোর সাথে বেশ কিছু ফ্যাক্টর ওতপ্রোতভাবে জড়িত । যে সমস্ত ফ্যাক্টর পোনা মজুদ ঘনত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করে পোনা মাছের বৃদ্ধির হারকে প্রভাবিত করে তা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. পানির স্রোত:
নিয়মিত জোয়ার ভাটা হয় এমন পানিতে অথবা একমুখী প্রবাহমান স্রোতের পানিতে মাছের মজুদ ঘনত্ব বাড়িয়ে খাচায় মাছ চাষে ভাল ফল পাওয়া যায়। এভাবে স্রোতশীল নদীর পানিতে ৬মিটারx৩মিটারx১.৫মিটার আকারের খাঁচায় ১০০০টি মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ করে চাষ করার মাধ্যমে প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ২৫ গ্রাম ওজনের বা তার চেয়ে বড় মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ করতে হবে। থাইল্যান্ড বা মালোশিয়ায় প্রতি ঘনমিটার আয়তনে ৬০টি পোনা মজুদ করা হয়; কিন্তু ডাকাতিয়া মডেল খাঁচায় নদীর স্রোত ও গভীরতার বিবেচনায় প্রতি ঘনমিটার আয়তনে ৩৩ টি পোনা মজুদ করা হচ্ছে।
২. জালের ফাঁসের আকার:
খাঁচায় ব্যবহৃত জালের ধরনের ওপরও মজুদ ঘনত্ব কম বেশি হয় এবং উৎপাদনও কমবেশি হবে। জালের ফাঁসের আকার বড় হলে ঐ খাঁচায় মজুদ ঘনত্ব বাড়ানো যেতে পারে। কারণ জালের ফাঁসের আকার (mesh size) বড় হলে খাঁচার ভিতরে পানির প্রবাহ বেশী হবে এবং গ্রহন উপযোগী অক্সিজেনের পরিমানও বেড়ে যাবে। অন্য দিকে জালের ফাঁসের আকার ছোট হলে খাঁচার ভিতরে পানির প্রবাহ কম হয়, ফলে গ্রহনযোগ্য অক্সিজেন সরবরাহও কম হয়ে থাকে। এজন্য পোনার মজুদ ঘনত্ব খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব হয় না। খাঁচায় জালের ফাঁসের আকার ০.৭৫ ইঞ্চি হিসাবে ব্যবহার করে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর রহমতখালী চ্যানেলে এবং চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে স্থাপিত খাঁচাগুলোতে ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।
৩. পানির গভীরতা:
খাঁচা স্থাপনে পানির গভীরতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। খাড়ি অঞ্চল অথবা পানির গভীরতা বেশি এমন অঞ্চল খাঁচায় মাছ চাষের জন্য অধিক উপযোগী এবং খাঁচায় গভীরতা বৃদ্ধিসহ মজুদ ঘনত্ব বাড়ানো সম্ভব হয়। অন্যদিকে যে স্থানে পানির গভীরতা কম সেখানে খাঁচা স্থাপন করে মাছ চাষে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয় এবং মজুদ ঘনত্ব কমিয়ে ফেলতে হয় ফলশ্রুতিতে ফলে মাছের উৎপাদন কম হয়। জোয়ার ভাটার প্রভাব সম্বলিত নদীতে ভাটার সময় যদি পানি আশংকাজনক হারে কমে যায়, তবে মজুদকৃত মাছ পর্যাপ্ত অক্সিজেন হতে বঞ্চিত হয়। এছাড়া উচ্ছিষ্ট খাবার খাঁচার তলদেশের কাদায় জমা হয় এবং এ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়, যা খাঁচার মাছের জহন্য বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৪. প্রত্যাশিত আকারের মাছ উৎপাদন:
খাঁচায় মাছ চাষের একটি সুবিধাজনক দিক হলো প্রত্যাশা অনুযায়ী যে কোনো আকারের মাছ উৎপাদন। বাজারে কত ওজনের মাছের চাহিদা রয়েছে সেদিক বিবেচনায় রাখতে হবে এবং তার ওপর ভিত্তি করে মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারন করে মাছ চাষ করতে হবে। যদি প্রতি ঘনমিটারে ৩৩ টি মাছ মজুদ করা যায় তাহলে ৬ মাসে গড়ে ৫০০ গ্রাম ওজনের তেলাপিয়া পাওয়া যাবে। যদি ৩০০ গ্রাম ওজনের মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাহিদা থাকে এবং ঐ পরিমাণ উৎপাদন পাওয়ার টার্গেট থাকে তবে প্রতি ঘনমিটারে ৪০-৫০ টি মাছ মজুদ করতে হবে। এমনকি ২০০ গ্রাম ওজনের মাছের চাহিদা ও বাজার মূল্য যদি আশানূরূপ হয় তাহলে মজুদ ঘনত্ব বাড়ানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫. খাদ্যের গুণগতমান:
খাদ্যের গুণগতমান ভাল হলে মাছের মজুদ ঘনত্ব বাড়ানো যায় এবং মাছের উৎপাদনও বেড়ে যায়; অন্যদিকে যদি খাদ্যের গুণগতমান ভাল না হয় তাহলে মাছের মজুদ ঘনত্ব বাড়ানো যাবে না এবং মাছের উৎপাদনও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাবে। বর্তমানে খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে ৩২% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দিয়ে প্রতি ঘনমিটারে ৬ মাসে ১৫ কেজি মনোসেক্স তেলাপিয়া উৎপাদন করা হচ্ছে। যদি ৩২% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের পরিবর্তে ৩৫-৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োগ করা যায় তাহলে আনুপাতিক হারে মাছ মজুদের ঘনত্ব বাড়ানো সম্ভব হবে এবং মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। তবে এেেত্র খাঁচায় যেন কোন প্রকার দূষনের প্রভাব না পড়ে সেদিকে ল্য রাখতে হবে।
৬. বিনিয়োগ মত্রা:
খাঁচায় আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ ব্যয়বহূল ও বানিজ্যিক চাষ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। একাজে উদ্যোক্তাকে অবশ্যই সকল প্রকার ব্যয় বহন করার মতা থাকতে হবে। সাময়িক ভাবে লোকসানের বিষয়ে বিচলিত না হয়ে চাহিদা অনূযায়ী বিনিয়োগ করে যেতে হবে। একাজে অংশগ্রহনকারী উদ্যোক্তাগনকে প্রযুক্তিগত কারণে প্রথম দিকে বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হয় এবং পরবর্তিতে ধীরে ধীরে বানিজ্যিক ভাবে লাভবান হতে হয়।
খাঁচায় মাছ চাষের মজুদ ঘনত্ব:
প্রবাহমান নদী অথবা অন্যান্য জলাশয় যেখানে প্রতিনিয়ত স্রোত বহমান থাকে সেসব জলাশয়ে নিম্নলিখিত ছক অনুযায়ী মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ করতে হবে।
মাছের প্রজাতি মজুদ সংখ্যা
মনোসেক্স তেলাপিয়া ১০০০
সরপুঁটি
১০০০
পাংগাস
৮০০
কার্পিও
৫০০
গ্রাস কার্প
৫০০
কালি বাউশ
৫০০
শিং
৮০০
মাগুর
৮০০
কৈ
৮০০
খাঁচার আকারঃ ২৭ ঘনমিটার হিসেবে ধরে
বিল, হাওর, বাঁওড় ইত্যাদি জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষের মজুদ ঘনত্ব:
বিল, হাওড়, বাঁওড় ইত্যাদি জলাশয় যেখানে স্রোত থাকে না সে সব জলাশয়ে নিম্নলিখিত ছক অনুযায়ী মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ করা যেতে পারে:
মাছের প্রজাতি মজুদ সংখ্যা
মনোসেক্স তেলাপিয়া ৬০০-৭০০
সরপুঁটি
৬০০-৭০০
পাংগাস
৪০০-৫০০
কার্পিও
৩০০-৪০০
গ্রাস কার্প
৩০০-৪০০
কালি বাউশ
৩০০-৪০০
শিং
৪০০-৫০০
মাগুর
৪০০-৫০০
কৈ
৪০০-৫০০
খাঁচার আকারঃ ২৭ ঘনমিটার হিসেবে ধরে
খাদ্য প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা
খাঁচায় ব্যবহার উপযোগী সম্পূরক খাদ্য:
সুষম সম্পূরক খাদ্যে সকল প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে এবং তা ব্যয় বহুলও বটে। এ জন্য এ সব খাদ্যের অপচয় রোধে সতর্কতার সাথে খাদ্য প্রয়োগ করা প্রয়োজন। প্রবাহমান নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের জন্য ভাসমান খাদ্য ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। এতে একদিকে মাছের চাহিদা অনুযায়ী খাবার প্রদান করা যায় এবং খাদ্যের অপচয় রোধ করা সম্ভব হয়। বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে মাছের খাদ্য বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করার জন্য বহু খাদ্য কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এসকল কারখানায় মাছের প্রজাতি ও বয়সের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় মাত্রার পুষ্টি উপাদান বিশেষত: আমিষের মাত্রা নিশ্চিত করে, বিভিন্ন আকারের দানাদার ভাসমান খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। তন্মধ্যে মেগা ফিডস, আফতাব ফিডস্ লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ, সিটি গ্রুপ, ইত্যাদি কোম্পানীর খাদ্য উল্লেখযোগ্য। চাষী বা খামার পর্যায়ে ভাসমান দানাদার খাদ্য তৈরি করা একদিকে যেমন অত্যাধিক ব্যয়বহুল অন্যদিকে এর জন্য পৃথক শিল্প ব্যবস্থাপনারও প্রয়োজন। এ কারণেই বাণিজ্যিকভাবে অনেক সংখ্যক খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষের বেলায় নিজেদের তৈরি পিলেট খাদ্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়। বরং বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ভাসমান খাদ্য ব্যবহার করাই উত্তম।
খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে খাদ্য নির্বাচনে আরো একটি বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। তা হলো খাদ্যের দানার আকার। সচরাচর মাছের মুখের আকারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্য দানার আকার নির্বাচন করা হয়। আমরা যে ওজনের তেলাপিয়া খাঁচায় মজুদ করি প্রাথমিকভাবে তাদের জন্য ন্যূনতম ৩ মিলিমিটার আকারের দানাদার খাদ্য প্রদান করতে হবে। আর যখন তেলাপিয়ার ওজন ৫০ গ্রাম হবে তখন তাদের জন্য খাবারের আকার বৃদ্ধি করে ৫ মিলিমিটার আকারের দানাদার ভাসমান খাবার প্রদান করতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা ও কৌশল:
মাছের খাদ্য গ্রহণ মাত্রা নির্ভর করে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলীর অনুকূল অবস্থার ওপর। তাপমাত্রা বাড়লে মাছের বিপাকীয় কার্যক্রমের হার বেড়ে যায়, ফলে খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পায়। একইভাবে পানির তাপমাত্রা কমে গেলে খাদ্য চাহিদাও কমে যায়। পানির পিএইচ মাত্রা ৭.০ – ৮.৫ পর্যন্ত থাকলে ও পানিতে দ্রবিভূত অক্সিজেনের মাত্রা বাড়লে মাছের খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিপরীতভাবে পিএইচ ও অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাবার কারণে খাদ্য গ্রহণ কমে যায়। এ ছাড়াও মাছ ছোট অবস্থায় তুলনামূলক বেশি খাবার গ্রহণ করে থাকে।
খাঁচায় মাছ চাষে খাদ্য প্রয়োগ করতে হয় চাহিদার ভিত্তিতে। খাঁচায় ভাসমান খাদ্য ব্যবহার করাই শ্রেয়; কেননা খাদ্য প্রয়োগ করা হলে খাদ্যের কোন অংশ অব্যবহৃত থেকে গেল কিনা তা তাৎণিকভাবে পর্যবেণ করা সম্ভব। প্রতিটি খাঁচায় দিনের নির্ধারিত সময়ে অল্প অল্প করে খাদ্য সম্পূর্ন খাঁচায় ছিটিয়ে প্রদান করা হয়। একবার প্রদানকৃত খাদ্য খাওয়া হয়ে গেলে আবার কিছু খাদ্য প্রদান করা হয়; এভাবে যখন দেখা যায় যে, খাদ্য গ্রহনের প্রবনতা অনেকটা কমে এসেছে অর্থাৎ খাদ্য গ্রহণ করছে তবে অনেকটা অলসভাবে; এমনকি দু চারটি খাদ্য দানা ভাসমান থেকে যাচ্ছে তখন ঐ খাঁচায় খাদ্য প্রদান বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ মাছের চাহিদা মাত্রা পূরণের কাছাকাছি পর্যন্ত খাদ্য প্রদান করা হয়। এভাবে প্রতিটি খাঁচায় একের পর এক যথেষ্ট সময় পর্যবেণ করে খাদ্য প্রদান করতে হবে। মনোসেক্স তেলাপিয়াকে খাঁচায় মজুদের পর হতে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত (৩০০-৩৫০ গ্রাম ওজন/প্রতিটি) যে খাদ্য প্রদান করা হয় তাতে দৈহিক ওজনের বিবেচনায় খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ৮% – ৩% এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। আর
তেলাপিয়ার ওজন যখন ৫০০ গ্রাম অতিক্রম করে তখন তাদের দেহে অধিক পরিমান চর্বি জমা হয়, ফলে খাদ্য গ্রহনের প্রবনতা অনেক হ্রাস পায়। এরা তখন তাদের দেহ ওজনের ১% এরও কম খাদ্য গ্রহন করে। তখন দিনে তাদেরকে একবার মাত্র খাদ্য প্রয়োগ করলেই চলে।
দৈনিক খাদ্য প্রয়োগ শিডিউল (feeding schedule):
বিভিন্ন বয়সের তেলাপিয়াকে দিনে বিভিন্ন শিডিউলে খাদ্য প্রদান করতে হয়। সচরাচর যে বয়সের বা আকারের মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা মজুদ করা হয় (২৫ – ৩০ গ্রাম ওজনের) তাদের জন্য দিনে ৪ বার খাদ্য প্রদান করা প্রয়োজন। আর তাদের ওজন ৫০ গ্রাম অতিক্রম করলে দৈনিক ৩ বার খাদ্য প্রদান করতে হবে এবং যখন তেলাপিয়া ১০০ গ্রাম ওজন অতিক্রম করবে তখন তাদেরকে দৈনিক ২ বার খাদ্য প্রদান করতে হবে।
মাছের দৈহিক আকারের ভিত্তিতে খাঁচায় বর্ননা অনুযায়ী যতবারই খাদ্য প্রয়োগ করা হোক না কেন, ল্য রাখতে হবে যেন একবার খাদ্য প্রদানের পর ছোট মাছের ক্ষেত্রে ৩ ঘন্টা এবং বড় মাছের ক্ষেত্রে ৪ ঘন্টা ব্যবধানের আগে দ্বিতীয়বার খাদ্য প্রদান করা না হয়; অর্থাৎ প্রতি দুই বার খাদ্য প্রদানের মাঝে ন্যূনতম ৩ ঘন্টা (ছোট মাছের ক্ষেত্রে) এবং ৪ ঘন্টা (বড় মাছের ক্ষেত্রে) ব্যবধান নিশ্চিত করেই তবে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
খাঁচায় খাদ্য প্রয়োগে বিবেচ্য বিষয়:
ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় ভাসমান খাদ্য প্রয়োগ
নমুনায়ন ও গ্রেডিং
নমুনায়ন:
খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে নমূনায়ণ করা হয় মাছের দৈহিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, খাঁচার জাল ইত্যাদি পর্যবেণের জন্য। এজন্য মাঝে মাঝে নির্ধারিত বিরতিতে প্রতিটি খাঁচার নীচে আড়াআড়ি ভাবে বাঁশ দিয়ে টেনে মাছগুলোকে খাঁচার এক পার্শ্বে জড়ো করে মাছের সার্বিক অবস্থা পর্যবেণ করা হয়।
গ্রেডিং:
যদিও খাঁচাতে পোনা মজুদের সময় যথাসম্ভব একই আকারের পোনা এক খাঁচায় মজুদ করা হয়। সময় অতিক্রমের সাথে সাথে মাছগুলোর মধ্যে দৈহিক বর্ধণ হারের তারতম্য দেখা যায়। ফলে খুব দ্রুত প্রতিটি খাঁচাতে পোনা আকার বিভিন্ন হয়ে যায়। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ নিয়মে খাদ্য প্রদানের মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় মাছের আকারের বৈষম্য সর্বনিম্ন রাখতে। এরপরও প্রতিটি মাছের ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক বর্ধণ প্রবনতা, খাদ্য গ্রহণের দতা ইত্যাদির কারণে সময়ের সাথে সাথে দৈহিক বর্ধণে তারতম্য সস্পষ্ট হতে থাকে। এজন্য নিদৃষ্ট সময় পর পর প্রতিটি খাঁচা থেকে মাছ বাছাই করে বড় ও ছোট মাছ গুলোকে গ্রেডিং করে ভিন্ন ভিন্ন আকারের মাছকে ভিন্ন ভিন্ন খাঁচায় স্থানান্তর করা হয়। এভাবে বিভিন্ন আকারের মাছ থেকে সম আকারের মাছ বাছাই করে নির্দিষ্ট খাঁচায় মজুদ করার পদ্ধতিই হলো গ্রেডিং বা বাছাইকরণ।
বাছাই বা গ্রেডিং এর প্রয়োজনীয়তা:
বাছাই এর সময় ও পদ্ধতি:
যে খাঁচাগুলোর মাছ বাছাই বা গ্রেডিং করা হবে তার পূর্বের দিন ঐ নির্ধারিত খাঁচাগুলোর মাছকে খাদ্য প্রদান বন্ধ রাখতে হয় যাতে গ্রেডিংকালে স্থানান্তর করতে গিয়ে মাছের শারিরীক পীড়নে মারা না যায়। নদীতে যেহেতু পানি সর্বদা প্রবাহমান থাকে অথবা জোয়ার ভাটার কারণে পানির স্তর উঠানামা করতে থাকে কাজেই শুধুমাত্র দিনের তাপমাত্রার দিকে ল্য রেখে সকাল বেলা কিংবা পড়ন্ত বিকালে মৃদু সূর্যালোকে খাঁচার মাছ বাছাই করতে হবে। যখন নদীর পানি বেশী প্রবাহমান থাকে তখন খাঁচার পানি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে, এ সময় খাঁচার মাছ গ্রেডিং করা উপযোগী। মাছ গ্রেডিং শুরু করার আগেই হাফ ড্রামে ৮০ লিটার পানি দিয়ে তাতে সামান্য পরিমান (০.২৫ গ্রাম) ম্যালাকাইট গৃন মিশাতে হবে। মাছ গ্রেডিং করে স্থানান্তর করার জন্য লম্বা হাতল বিশিষ্ট হ্যান্ড নেট ব্যবহার করতে হবে। হ্যান্ড নেটের আকার বুঝে স্বল্প সংখ্যক মাছ একেবারে খাঁচা থেকে উঠিয়ে নৌকাতে রাখা ড্রামের পানিতে বাছাই করে রাখতে হবে। এভাবে ৫/৭ মিনিটের মধ্যে ছোট মাছ হলে ৬০/৭০টি আর বড় মাছ হলে ২০/২৫টি মাছ নিয়ে প্রত্যাশিত খালি খাঁচায় দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে বড় মাছগুলো বাছাই করে অন্য খাঁচায় নিয়ে গেলে ছোটগুলো আগের খাঁচায় রয়ে যাবে। এভাবে একের পর এক সব খাঁচার মাছ বাছাই করে ফেলতে হবে। পাশাপাশি ৩টি খাঁচার মাছ পর পর কিংবা একই সাথে বাছাই করলে মাছগুলোকে বেশী দূরত্বে স্থানান্তর করতে হয় না। ফলে মাছের ওপর স্থানান্তর জনিত চাপ তুলনামুলকভাবে অনেকাংশে কম হয়। এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচার দূরত্ব বেশী হলে তখন ড্রামে পানি নিয়ে বাছাই করতে হবে।
একটি খাঁচায় মাছের মজুদ এবং তা থেকে আকার ভিত্তিক মাছ বাছাইয়ের ধারাবাহিক বিবরণ:
আরহণযোগ্য মাছের আকার ওজন, বাজার চাহিদা, চাষের মেয়াদ ও ব্যবস্থাপনার ধরণ বিবেচনায় রেখে মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। খাঁচার সব মাছ একত্রে বাজারজাতের উপযোগী আকার ধারণ করে না। তাই বড় মাছগুলো বাছাই করে বাজারে প্রেরণের জন্য পৃথক এক বা একাধিক খাঁচায় রাখতে হবে। এতে একদিকে যেমন একই আকারের মাছ গ্রেডিং করার কারণে উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যায়, অন্যদিকে ধীরে ধীরে ছোট মাছগুলো বড় হওয়ার জন্য অতিরিক্ত স্থান ও সময় পাবে। মাছ বাজারে প্রেরণের সময় যদি মাছের পেটে খাদ্য ভর্তি থাকে তবে মাছের গুণগত মান নষ্ট হওয়াকে তরান্বিত করে। এজন্য মাছ বাজারে প্রেরণের আগের দিন ঐ খাঁচায় দুপুরের পর খাদ্য প্রদান বন্ধ রাখতে হবে। এতে বাজারজাতের জন্য প্রেরিত মাছের গুণগত মান অধিক সময় অুন্ন থাকবে।
আহরণপূর্ব বিবেচ্য বিষয়:
মাছ আহরণ ও বাজারজাত পদ্ধতি:
মাছ বাজারজাতকরণের আগের দিন বিভিন্ন খাঁচা হতে বাজারজাত উপযোগী আকারের মাছকে বাছাইয়ের মাধ্যমে বাজারজাতের জন্য স্থাপিত ভিন্ন খাঁচায় মজুদ করা হয়। যে মাছগুলোকে নির্ধারিত দিনে বাজারে প্রেরণ করা হবে সেগুলোকে আগের দিন দুপুরের পর আর কোন খাদ্য প্রদান করা হয় না। ফলে বাজারজাতকরণের পর মাছ মারা গেলেও মাছের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা ও গুণগুত মান অধিক সময় পর্যন্ত অূন্ন। নিকটতম বাজারে উপযোগী পাত্র বা ড্রামে পানিতে পরিমিত সংখ্যায় জীবন্ত সরবরাহ করা হয় অথবা দূরবর্তী বাজারে বরফ দ্বারা সংরণ করে পাঠানো যায়। আর ধৃত মাছ নিকটবর্তী পাইকারী বাজারে সঠিক সময়ে ঝুড়িতে করে তাড়াতাড়ি পৌছানো হয়।
মাছ বাজারজাতকরণ:
খাঁচা হতে সাধারণত: বড় আকারের মাছ বাজারজাত করা হয়। তাই এসব মাছের বাজারমূল্য বেশী হয়। কিন্তু এ মাছগুলো খাঁচার পাশেই পাইকারদের কাছে বিক্রি করলে অনেক সময়ই ভাল দাম পাওয়া যায় না। খাঁচায় চাষকৃত মাছ ভাল দামে বিক্রির জন্য নিম্নলিখিত পদপেগুলো গ্রহন করা যেতে পারে:
নিয়মিত পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
খাঁচায় মাছ চাষের উৎপাদন অনেকাংশে নির্ভর করে নিয়মিত খাঁচা ব্যবস্থাপনার উপর। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাঁচায় মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
নদীতে ভাসমান খাঁচাতে যেহেতু সার্বণিক পানি পরিবর্তন হতে থাকে ফলে খাঁচার মাছ প্রতিনিয়ত অক্সিজেনসমৃদ্ধ নূতন পানির পরিবেশ লাভ করে। তাই নদীতে খাঁচায় মাছে রোগ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তবে শীতের শুরুতে নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের ন্যায় প্রচলিত কিছু রোগ দেখা দিতে পারে। আবার বর্ষার শুরুতে যখন কৃষি জমি বিধৌত কীটনাশকসমৃদ্ধ পানি নদীতে এসে পতিত হয়, তখন খাঁচার মাছের গায়ে লাল দাগ, ছত্রাকজনিত রোগ, তরোগ ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। ডাকাতিয়া নদীতে স্থাপিত খাঁচাগুলোতে এখন পর্যন্ত শুধু সামান্য লাল দাগ ও কদাচিৎ ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দেয়। এ দুটির যে কোন রোগ দেখা দিলে রোগের মাত্রার বিবেচনায় তাৎণিক ভাবে নিুবর্ণিত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়:
(ক)
ফরমালিন ও মিথিলিণ ব্লু দ্রবণে গোসল:
যেহেতু পুকুরের মাছের ন্যায় খাঁচার মাছে তার পরিবেশে তথা পানিতে ঔষধ প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না তাই এখানে খাঁচার মাছকে খাঁচা থেকে বাইরে এনে সুবিধাজনক পাত্রে ফরমালিণ দ্রবণে গোসল করানো হয়। খাঁচায় রোগ দেখা দিলে খাচার মাছকে ফরমালিণ দ্রবণে গোসল করানোর পদ্ধতি নিম্নরুপ:
এভাবে সমস্ত খাঁচার মাছকে গোসল করাতে হবে। রোগের তীব্রতা বুঝে প্রয়োজনে ৭ দিন পর আবার মাছগুলোকে ফরমালিন ও মিথিলিন ব্লু দ্রবণে গোসল করাতে হবে।
(খ)
এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো:
ফরমালিণ দ্রবণে গোসল করানোর দিন থেকেই খাঁচার মাছকে ভাসমান খাদ্যের সাথে এন্টিবায়োটিক মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। খাদ্যের সাথে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানোর পদ্ধতি:
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে দণি এশিয়ার কয়েকটি খাঁচায় মাছ চাষ করে রপ্তানীর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। খাঁচা ব্যবস্থাপনায় মাছ চাষের এ প্রযুক্তি দিন দিন উৎকর্ষ লাভ করছে। আমাদের দেশে এ প্রযুক্তি এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। চাঁদপুর ও লীপুর জেলায় বিগত কয়েক বছরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সংগতি রেখে আধুনিক প্রযুক্তিতে খাঁচায় মাছ চাষ চলছে। এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকা ও পারিপার্শি¦কতায় বিভিন্নমূখী যে সকল ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে সেগুলোকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
কারিগরী ঝুঁকি
প্রাকৃতিক ঝুঁকি
সামাজিক ঝুঁকি
পরিবেশগত ঝুঁকি:
ঝুঁকি সমুহের সম্ভাব্য সমাধান:
লক্ষ্মীপুরের রহমতখালী চ্যানেলে ক্রমবর্ধমান খাঁচার ইউনিট খাঁচায় মাছ চাষের আর্থিক বিশ্লেষণ
খাঁচায় মাছ চাষ মূলত: উন্মুক্ত বা বদ্ধ জলাশয় ব্যবস্থাপনার একটি কৌশল। আমাদের দেশের সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থা বিবেচনা করে দেশের কোথাও কোথাও চাষীরা পুকুরেও এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। খাঁচায় মাছের উৎপাদন কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না বরং অনেকগুলো বিষয়কে বিবেচনায় রেখে উৎপাদন পরিকল্পনা করতে হয়। উৎপাদন পরিকল্পনা ও খাঁচা ব্যবস্থাপনার ওপরেই এর সফলতা নির্ভর করে। নিম্নে ডাকাতিয়া মডেলে খাঁচায় তেলাপিয়া চাষের ফলাফলের ভিত্তিতে খাঁচা স্থাপনা ব্যয়, উৎপাদন ব্যয় এবং একটি উৎপাদন চক্রে উৎপাদনের চিত্র দেখানো হলো:
১০ টি খাঁচার (৬ মিটারx৩ মিটারx১.৫মিটার) সার্বিক অর্থনীতি:
১। খাঁচা স্থাপনের স্থায়ী খরচ:
খাঁচার ড্রাম, ফ্রেম ব্যতিত শুধু জাল দ্বারা একটি খাঁচা তৈরীর খরচ:

সর্বমোট উৎপাদন খরচ = ২৭৭৬৭৫.০০ টাকা
মাছের মৃত্যুহার = ৫% = ৫০০ টি
মোট উৎপাদিত মাছ = ৯৫০০ টি = ৪০০০ কেজি
মোট বিক্রয় = ৪০০০ কেজি x ১২০.০০=৪৮০০০০.০০ টাকা
নীট লাভ = বিক্রয় মূল্য – উৎপাদন খরচ = ৪৮০০০০.০০ – ২৭৭৬৭৫.০০=২০২৩২৫.০০ টাকা
মুনাফার হার: ৪২.১৫%
৬ মাসের ফসল হিসাবে খাঁচায় বছরে ২টি ফসল উৎপাদন করা যাবে। তাহলে ১ বছরে উৎপাদন খরচ ও আয় হবে নিুরূপ:
মোট উৎপাদন খরচ = ২৭৭৬৭৫.০০x২= ৫৫৫২৫০.০০ টাকা
মোট বিক্রয় = ৪০০০ কেজি x ১২০.০০ x ২ = ৯৬০০০০.০০ টাকা
নীট লাভ = ৬, ৬৫,০০০.০০ – ৫৫৫২৫০.০০ = ৪০৪৭৫০.০০ টাকা

প্রণয়নে: মো: আসাদুল বাকী, বায়োলজিস্ট, মৎস্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, চাঁদপুর।